Bee মত প্রকাশের স্বাধীনতা এবং বর্তমান সরকার Star

লিখেছেন লিখেছেন মামুন ১১ সেপ্টেম্বর, ২০১৪, ০৯:১০:৪৫ সকাল



[ ফেসবুকে আমার এক বন্ধু মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর একজন কাছের মানুষ (মাহাবুবুল হক শাকিল) এর একটি স্ট্যাটাস আপডেট শেয়ার করেছিল। আমি সেই স্ট্যাটাস এর উপর নীচের লেখাটি লিখেছিলাম। এই ঘটনাটি তখনই হয়েছিল, যখন মত প্রকাশের বিরুদ্ধে নতুন আইন সংশোধন করে একটি নতুন বিতর্কের জন্ম দেয়া হয়েছিল। আমি আশ্চর্যজনকভাবে দেখলাম সর্বমোট ১১৩ জন আমার সেই লেখাটি পড়লেও একটিও 'লাইক' পড়ল না। অর্থাৎ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে যারা প্রতিদিন আমার আলতু-ফালতু লেখায়ও বিনা দ্বিধায় 'লাইক' দিয়েছে; তাঁদের ভিতরে এই আইনের কোপানলে পড়বার ভীতি এতোটাই কাজ করেছে যে, স্বয়ং লেখকের থেকেও তাঁরা বেশী ভীত ছিল। শাকিল সাহেব বলতে চেয়েছিলেন, নতুন এই আইনের দ্বারা দেশ মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর সুযোগ্য নেতৃত্বে মালয়েশিয়া কিংবা সিঙ্গাপুরের মত উন্নতির দিকে ধাবিত হবে। ঐ দুটি দেশের দুজন নেতার তৎকালীন মত প্রকাশের স্বাধীনতা রুদ্ধ করার এবং বিরোধী নেতাদের 'হাইবারনেশনে' পাঠানোর কথা উল্লেখ করেছিলেন। আমি সেই লেখার পরিপ্রেক্ষিতে নীচের প্রথম অংশটুকু হুবহু তুলে ধরছি। আর দ্বিতীয় অংশে দেখানোর চেষ্টা করবো আওয়ামী লীগ সরকার যতই গনতন্ত্রের কথা বলুক না কেন আদতেই কি তাঁরা তাই?]

Good Luckপ্রথম অংশঃ

" একটু কম বুঝি তো... তাই আমার বুঝে আসেনা, উন্নয়নের প্রয়োজনে গণতন্ত্র এবং বাক-স্বাধীনতাকে কেন হিমাগারে পাঠাতে হবে! আর শেখ হাসিনা যদি গণতন্ত্র বা বাক-স্বাধীনতাকে নির্বাসন না-ই দিতে চান, তবে কেন এই কালা-কানুন?

উদাহরণ দেবার বেলায় একজন মাহাথির মোহাম্মাদ বা লী কুয়ানের কথা উল্লেখ করা যায়; কিন্তু আদতেই আমরা কিংবা আমাদের নেতারা ঐ লোক দুজনের ভালো গুণের দুটির এক কোনাও নিজেদের ভিতর অর্জন করতে পেরেছি বা পেরেছেন?

উন্নত রাষ্ট্রগুলোতে একটি ফেরি ডুবিতে সে দেশের শীর্ষ নেতারা এর দায়ভার গ্রহন করে ক্ষমতা থেকে সরে যায়... আমাদের দেশে একের পর এক লঞ্চ ডুবিতে মানুষ মারা যাচ্ছে। কই? একজন সংশ্লিষ্ট মন্ত্রীকেও তো দেখলাম না পদত্যাগ করতে? পাশের 'বন্ধু রাষ্ট্র' ভারতের বেলায়ও দেখেছি, রেল দুর্ঘটনার দায় নিয়ে রেল মন্ত্রীকে পদত্যাগ করতে। আর আমাদের দেশের মন্ত্রীর (কালো বিড়ালদের যম হিসাবে আবির্ভূত হয়ে নিজেই কালো বিড়ালে পরিণত হয়েছিলেন) গাড়িতে ৭০ লক্ষ টাকা পাবার পরও তার মুখ দিয়ে একটুও অনুশোচনা বের হল না। অনেক নাটক... তদন্তের পরে এই টাকার মালিকানা রহস্যের ধুম্রজালে আটকে গেলো। উদোর পিন্ডি বুধোর ঘাড়ে চাপানো হল... দফতরবিহীন মন্ত্রীর তকমা এঁটে এক কালো বিড়াল বহাল রইলেন। অথচ যে আইন এখন হচ্ছে, আগামীকাল থেকে এই কথা ফেবুতে থাক, হয়তো চিন্তাও করা পাপ হবে। আর এর ভিতরেই নিহিত সকল উন্নয়নের উপাদান!!! একজন চোরকে চুরি করতে দেখেও নিশ্চুপ থাকার ভিতরেই দেশের উন্নয়ন!!!?

একজন বিতর্কিত সাবেক যোগাযোগ মন্ত্রীর জন্য বিশ্ব ব্যাংক পদ্মা সেতুতে অর্থায়ন বন্ধ করে দিলো। ঐ মন্ত্রী কেমন সেটা নিয়ে তর্ক-বিতর্ক না করেও যদি দেশের স্বার্থে তাঁকে সরিয়ে দেয়া হতো, আজ দেশের দক্ষিনাচলের সাথে সারা দেশের যোগাযোগের অভূতপুর্ব উন্নয়ন সাধিত হতো।

আমি নির্দিষ্ট কোনো দলের নাম নিচ্ছি না। একটা সিস্টেমের কথাই বলছি। যুগ যুগ ধরে করাপ্টেড সিস্টেম। প্রতি পাঁচ বছরে এমপিদের মনোয়নের নামে যে ইন্টারভিউ চলে, শুনেছি, সেখানে কোটি কোটি টাকার লেনদেন হয়। আর ওনারা বেশী টাকা দিয়ে মনোনয়ন বাণিজ্যের রেসকোর্সের ময়দানের বিজয়ী নির্বাচনী বৈতরণী পার হয়ে আগে নিজের 'ইনভেস্ট' করা টাকা তোলায় ব্যস্ত থাকে। আমি আমার বর্তমান বসবাস করা এলাকার এক সাবেক এমপি'র কথা জানি, যিনি নিজ আত্মীয় স্বজনদেরকেসহ দলীয় কর্মীদের জন্য একটি রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ জোনের সকল বৈধ-অবৈধ আয়ের পথকে নিষ্কন্টক করেছিলেন। এখন এই কাজের কোনোই সমালোচনা করা যাবে না, তাতে দেশের উন্নয়ন রুদ্ধ হয়ে যাবে।

এরশাদ সাহেবকে সবাই স্বৈরশাসক বলে থাকেন। মানলাম তিনি স্বৈরশাসক। কিন্তু তার পতনের পর থেকে 'গণতন্ত্রের' নামে যে অদৃশ্য স্বৈরতন্ত্র চলেছে, সেটাও কি ঠিক ছিল? গণতন্ত্রের সংগায় আব্রাহাম লিংকন তার বিখ্যাত যে কথাটি বলেছিলেন, আজ আমাদের দেশের প্রচলিত গণতন্ত্রের ভিতরে আমাদের 'জনগনের' জন্য এমন নিষ্ঠ কোনো সরকার দেখতে পেয়েছি বা পাচ্ছি কি? এবার তো নিজের ভোটটাই দিতে পারলাম না! আর এখন জনগনের কথা বলার অধিকার, তাও নতুন কালাকানুনের দ্বারা কেড়ে নেবার জোগাড় চলছে।

১৯৯১ থেকে ২০০৯ এর প্রতিটি নির্বাচনে যিনি পরাজিত হয়েছেন, তিনি সূক্ষ্ণ কারচুপি কিংবা আন্তর্জাতিক চক্রান্তের দোহাই দিয়ে নির্বাচনকে মেনে নেন নাই... আমাদের দেশের দুই নেত্রীর মানসিকতা এমন দেখেছি, নিজেদের মুখ দেখাদেখিতেও ওনারা লজ্জা পেয়েছেন। সসস্ত্র বাহিনীর অনুষ্ঠানে দুই নেত্রী একই অনুষ্ঠানে যেয়েও কেউ কারো সাথে কথা বলেন নাই... প্রয়াত প্রেসিডেন্ট জিল্লুর রহমান মারা যাবার পরে, পাপন সাহেবের বাড়িতেও দুজন গিয়ে এঁকে অন্যের সাথে কথা বলেন নাই। পক্ষন্তরে, এবার ভারতীয় কংগ্রেসের বিশাল ভরাডুবির পরেও সোনিয়া গান্ধী নরেন্দ্র মোদীর শপথ অনুষ্ঠানে গিয়েছেন। আমাদের দুই নেত্রীর বেলায় এরকম আশা করাটা কি সম্ভব? যদি সম্ভব না-ই হয়, পাশের দেশের নেতা-নেত্রীদের মত যদি আমাদের নেত্রীরা না পারেন, তবে উদাহরণ টানবার বেলায় কেন মালয়েশিয়া বা সিঙ্গাপুরের নেতাদের টানা হচ্ছে? ... [মালয়েশিয়ার মাহাথির বা সিঙ্গাপুরের লী কুয়ানের স্বপ্ন ছিল দেশকে উন্নত বিশ্বের সমকক্ষ করে গড়ে তোলা। তারা তা পেরেছেন। উন্নয়নের প্রয়োজনে তারা গণতন্ত্র এবং বাক-স্বাধীনতাকে হিমাগারে পাঠিয়েছিলেন। বিরোধীরা গিয়েছিলেন রিপ ভ্যান উইংকেলের মতো ঘুমের দেশে।- মাহাবুবুল আলম শাকিলের স্ট্যাটাস এর মূল অংশ]... আমরা তো আমাদের প্রায় একই সংস্কৃতির পাশের দেশের নেতাদের মতই হতে পারছি না, তবে আর দূরের উদাহরণ কেন?

নিন্দুকেরা বলছেন, বিরোধী দলের ক্রমবর্ধমান আন্দোলনকে চাঙ্গা করতে না দিতেই এই কালাকানুন... সরকারবিরোধী পত্রিকায় যাতে সরকারের ভুল-ত্রুটি আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে না দেওয়া হয়, তাই এই আইনের অবতারণা। কিন্তু একটা কথা কেন কারো বুঝে আসছে না, সত্যকে কখনো চেপে রাখা যাবে না। একদিন না একদিন তা বের হয়ে আসবেই। আর জনগনের কন্ঠকে কখনো রোধ করা যাবে না... যায়ও না। ইতিহাস সে কথা বলে।

তাই একজন শেখ হাসিনাকে মাহাথির মোহাম্মাদ বা লী কুয়ানের অনুসরণ করার ক্ষেত্রে তাঁদের সময়ের প্রয়োজনে গ্রহনকৃত কালাকানুন কে-ই আগে নেবার প্রয়োজন নেই। ঐ সব মহান নেতাদের ইস্পাত দৃঢ় মনোবল এবং খাঁটি দেশপ্রেম সর্বাগ্রে তৈরী করতে হবে। মন্ত্রী এমপি এবং রাষ্ট্রের প্রতিটি ক্ষেত্রে যারা দুর্নীতি করছে, ইন্সট্যান্ট তাদেরকে স্যাক করে দ্রুত বিচার ট্রাইবুনালে বিচার করতে হবে... খাদ্যে ভেজালকারীদেরকে বিচার করে প্রকাশ্যে ফায়ারিং স্কোয়াডে মেরে ফেলতে হবে (চীনে এভাবে কার্যকর করা হয়)... তাঁদের ভিতরে যদি নিজ দলের প্রভাবশালী মন্ত্রীও যুক্ত থাকেন, পিছু হটা যাবে না... নিয়োগ বানিজ্য বন্ধ করতে হবে... প্রশ্নপত্র ফাঁস হবে না... টাকার বিনিময়ে মেধাবীদের বাদ দিয়ে বিসিএস এ নিয়োগ... পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়োগ... থানায় ঘুষ ছাড়া কাজ না হওয়া... আর কত বলবো?- এই সব কিছু যদি এই সরকার করায় নিষ্ঠাবান হতে পারে, এই কালাকানুনকে আমি স্বাগত জানাবো।

আসলে তখন তো আর সত্য কথা বলার প্রয়োজনই হবে না। তাই বাইরের উদাহরণ না টেনে নিজ দেশের সিস্টেমের গলদকে ফাইন্ড আউট করে সেটা মিটাতে তৎপর হলে ভালো হবে। কোনো ধরণের কালাকানুন-ই ভালো নয়, এবং সেটা বেশীদিন ও টিকেনা। জিয়াউর রহমানের ইন্ডেমনিটি আইনও তো বাদ দেয়া হয়েছে। বাকশালের সময়ের চারটি ছাড়া বাকি সংবাদ পত্রেরও কন্ঠরোধ করা হয়েছিল... পরিণাম আমাদের জানা আছে।

আমি নির্দিষ্ট কোনো দলের সমর্থন করি না। আমি সব সময় সত্যের পক্ষে থাকতে চাই। শেখ হাসিনা বা খালেদা জিয়ার দ্বারা কৃত ভালো কাজগুলোর প্রশংসা করতে চাই, একই সাথে তাঁদের সরকারের খারাপ দিকগুলোরও নিন্দা করতে চাই... তবে পজিটিভ ওয়েতে। যাতে করে ঐ খারাপ দিকটি ভালো দিকে পরিণত হতে পারে। আমি একজন বাংলাদেশী... পরবর্তী প্রজন্মের জন্য একটি সমৃদ্ধ দেশ উপহার দিতে নিজের পক্ষে যা করা সম্ভব করে যেতে চাই... একটি বিশাল ধান্দাবাজির সেকশনে জব করেও গরিবী হালতে জীবনযাপন করি... তাই দূর্নীতি এবং হারামিপনায় জড়িতদেরকে প্রচন্ড ঘৃণা করি। সে যদি দেশের প্রধান নির্বাহীও হয়, আমার কিছু করার নেই।

এই আইনের পর হয়তো এভাবে আর লিখার সুযোগ হবে না। তবে অপেক্ষায় থাকবো একদিন ভোর হবে... শুভবুদ্ধির উদয় হবে... আবার লিখতে পারবো। সেই পর্যন্ত হৃদয়ে তীব্র ঘৃণা নিয়ে অপেক্ষায় রইলাম... ... ..."

Good Luckদ্বিতীয় অংশঃ

আওয়ামী লীগ, গণতন্ত্র এবং শ্রমিকবান্ধব সরকারঃ

সেই ছোটবেলায় বাসায় বঙ্গবন্ধুর একটি প্রমাণ সাইজের ছবি দেখে এসেছি। আব্বার কাছ থেকে ১৯৭১, স্বাধীনতা এবং বঙ্গবন্ধু সম্পর্কে অনেক কিছু জেনেছি। সেই শিশু বয়স থেকেই হৃদয়ে এক মহান নেতার জন্য ভালোবাসা অনুভব করেছি। এরপর সময় সময়ের নিয়মে গড়িয়েছে। গত ২০ আগষ্ট ৪৩ বছরে পড়েছি। জেনেছি অনেক কিছু... শুনেছি... পড়েছি। কিন্তু বিশ্বাস করেছি কতটুকু?

পোষাক শিল্পের সাথে গোলামীর জিঞ্জিরের সূত্রধরে শ্রমিক ও মালিক-দু'পক্ষের সাথেই লিঙ্কড রয়েছি এখন। ভিতরের অনেক কিছুই জানা হয়েছে। তবে তোবা গ্রুপের একটি গার্মেন্টসের শ্রমিকদের সেই ঈদের দিন থেকে অনশন এবং তাদের ধর্মঘট ডাকা পর্যন্ত যা কিছু হয়েছে, সেটাকে আসলে কি বলা যায়? মালিক পক্ষের সেচ্ছাচারিতা? সরকারের ইচ্ছাকৃত উদাসীনতা? বিজিএমইএ'র কূটিলতা? আওয়ামী লীগ নিজেকে শ্রমিকবান্ধব সরকার বলে দাবী করে আসছে। সেই শ্রমিকবান্ধব সরকারের আমলে ভুখা-নাঙ্গা সমাজের 'ইতর শ্রেনী' বলে পরিগনিত (আসলে এরাই বর্তমানে দেশের উন্নতির চাবিকাঠী) হাজারখানেক শ্রমিকের তিনমাসের বেতন-বোনাস সঠিক সময়ে না দেওয়াতে ন্যায্য পাওনার দাবীতে যখন এরা একাট্টা হয়েছে, তখনই রাষ্ট্রীয় পুলিশ বাহিনীর শিকারি কুকুরের মত এদের উপরে ঝাপিয়ে পড়ার ছবি এবং ভিডিও দেখে আমার ভাবনাগুলো দিক পরিবর্তন করতে বাধ্য হয়েছে। শ্রমিকদের জন্য আওয়ামী লীগ সরকার বিগত সরকারগুলোর থেকে অনেক বেশী সুযোগ-সুবিধা এনে দিয়েছে, এই ইস্যুটি কেমন বিতর্কিত হয়ে গেলো।

কেন ঈদের আগে দু'মাসের বেতন এবং বোনাস বাকি থাকবে? কেন দেয়া হলো না? এটা কি দেলোয়ার হোসেন নামের একজন মালিককে জেল থাকে বের করে আনতে মালিকপক্ষের সংগঠনের সাথে সরকারের সংশ্লিষ্ঠ মহলের যোগসাজসের কুটিল ফল নয়? না হলে জেলখানায় বসে কি তিনি চেকে স্বাক্ষর করতে সক্ষম ছিলেন না? নাকি সেখানে আইনের কোনো গোপন মারপ্যাচ নিহিত ছিল? এখন তো অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, তাজরীন ফ্যাশনের পুড়ে মরা নিহত শ্রমিকদের মামলা থেকে সুকৌশলে দেলোয়ারকে বের করে আনতেই এই অযৌক্তিক নাটকের অবতারণা।

আমি শ্রমিকদের এই ন্যায্য দাবীর সাথে একাত্মতা পোষণ করছি। আর এখন একটু অন্য আলোচনায় গিয়ে ধারাবাহিকভাবে দেখানোর চেস্টা করবো যে, বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকার মুখে যতই গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্রের কথাই বলুক না কেন, আসলে অনেক আগে অর্থাৎ সেই স্বাধীনতার ঊষালগ্ন থেকেই এই দলটি সম্পদশালীদের সার্থকেই দেখে এসেছে। সুতরাং আজ যা দেখছি, তাতে অবাক হবার কিছুই নেই। ১৯৭২ সালের সংবিধানের ৪ মূলনীতির প্রথম দুটি- গণতন্ত্র এবং সমাজতন্ত্র একই সাথে রাষ্ট্রীয় মূলনীতি হিসাবে পাশাপাশি সন্নিবেশ করাটা আসলেই কি প্রকৃত অর্থে পরস্পরবিরোধী এই দুটি স্তম্ভের অবতারণার দ্বারা 'কানারে হাইকোর্ট দেখানোর' মত হাস্যকর ব্যাপারে পরিণত করা হয়েছিল না?

মেজর (অবঃ) এম এ জলিলের 'অরক্ষিত স্বাধীনতাই পরাধীনতা' বইটির আলোকে সেখান থেকেই কিছু কিছু উদ্ধৃতির মাধ্যমে ক্রমান্বয়ে দেখানোর চেষ্টা করবো যে, জন্মলগ্ন থেকেই আওয়ামী লীগ সরকার বিত্তহীন কিংবা শ্রমিকদের পরিবর্তে উচ্চবিত্ত তথা মালিক পক্ষের স্বার্থ রক্ষা করে এসেছে।

মেজর (অবঃ) এম এ জলিল একজন সেক্টর কমান্ডার ছিলেন। স্বাধীনতা যুদ্ধে তার অবদান অন্য যে কারো থেকে কোনো অংশেই কম নয়। তার নিজস্ব রাজনৈতিক দর্শন অনেকেরই পছন্দ নাও হতে পারে। কিন্তু কিছু কিছু ব্যাপারে তার চুলচেরা বিশ্লেষণ ব্যাপক গুরুত্ব বহন করে। তার 'অরক্ষিত স্বাধীনতাই পরাধীনতা' বইটি থেকে কিছু অংশ হুবহু তুলে ধরছিঃ-

[ পৃষ্ঠা নং ৭০-৭২]

“... এবারে তাহলে দেখা যাক, '৭২-এ প্রণীত সংবিধানের ৪ মূলনীতি বাংলাদেশের বাস্তবতার সাথে কতখানি সংগতিপুর্ণ। প্রথমে গণতন্ত্র। এখানে সংসদীয় গণতন্ত্রের কথা বলা হয়েছে। পশ্চিমা ধাঁচের এই 'সংসদীয় গণতন্ত্র' বাংলাদেশের বাস্তবতার মুখে কেবল অচলই নয়, স্বৈরতান্ত্রিকও বটে।'সংসদীয় গণতন্ত্র' পুঁজিবাদের রাজনৈতিক স্লোগান। এই সংসদীয় গণতন্ত্র পুঁজিবাদ প্রবর্তিত আমলাতান্ত্রিক প্রসাশনিক কাঠামোকে বহাল তবিয়তে টিকিয়ে রাখার মূলমন্ত্র।শোষণ-জুলুম ভিত্তিক সমাজ কাঠামোই হচ্ছে পুঁজিবাদের ভিত্তি। সম্পদের ব্যক্তি মালিকানায় বিশ্বাসী পুঁজিবাদ তার চরিত্রগত শোষণ-জুলুম অব্যাহত রাখার স্বার্থে প্রবর্তন করেছে আমলাতান্ত্রিক প্রশাসনিক কাঠামো। এই শোষণমূখী আমলাতান্ত্রিক প্রসাশনিক কাঠামোয় যাতে কেউ কোনরুপ অনিষ্ট সাধন না করতে পারে তার জন্য সংসদীয় গণতন্ত্র একটি মোক্ষম ফাঁদ সৃষ্টি করেছে যার নাম 'সংসদীয় নির্বাচন'। সংসদীয়ই নির্বাচনের কাজই হচ্ছে আমলাতান্ত্রিক প্রসাশনিক কাঠামোকে 'নিউ লীজ অফ লাইফ' প্রদান করা, অর্থাৎ নির্বাচন অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে আমলাতান্ত্রিক নতুন জীবন দান করা। এভাবেই সংসদীয় গণতন্ত্র সংসদীয় নির্বাচনের মধ্য দিয়ে পুঁজিবাদভিত্তিক শোষণ-জুলুমমূখী আমলাতান্ত্রিক প্রসাশনিক কাঠামোকে ধারাবাহিকভাবে টিকিয়ে রাখে। অন্য কথায়, সংসদীয় গণতন্ত্র পুঁজিবাদী শোষণ-শাসনের ভিতকেই কেবল টিকিয়ে রাখে না, উত্তরোত্তর মজবুতও করে তোলে।

এ ছাড়াও সংসদীয় গণতন্ত্র সম্পদশালীদেরকেই আইনপ্রণয়নকারী সংস্থার প্রতিনিধিত্ব অর্জনে সাহায্য করে। সংসদীয় গণতন্ত্র হচ্ছে বিত্তবানদের গণতন্ত্র, বিত্তহীনদের গণতন্ত্র নয়। সংসদীয় গণতন্ত্রে আইন প্রনয়নকারী সংস্থার প্রতিনিধি হিসেবে বিত্তবান শ্রেণীর লোকেরা নিজেদের স্বার্থ এবং মর্জী মাফিক নতুন নতুন আইন প্রণয়ন এবং আইন ভঙ্গেরও বেপরোয়া ক্ষমতার অধিকারী হয়। সমগ্র প্রশাসনই বিত্তবানদের অনুগত তাবেদার হয়ে থাকে। এই ধরণের সমাজ কাঠামোতে কোটি কোটি বিত্তহীন শ্রমজীবী মানুষের যেখানে কর্মসংস্থান হয় না, তারা খুঁজে পায় না এক মুঠো অন্ন, সে সমাজেই মুষ্টিমেয় বিত্তবানদের কাছে জমে ওঠে সম্পদের পাহাড় এবং দারুন স্বেচ্ছাচারিতার সাথে তারা বিভিন্ন আরাম-আয়েশ, ভোগ-বিলাস এবং অনুৎপাদক কর্মকান্ডে বেশুমার অর্থ-সম্পদ অপচয় করে বেড়ায়। সংসদীয় গণতন্ত্রের রাজ্যে এ সকল বিত্তবানদের জন্য আইন থাকে নীরব এবং অন্ধ। কারন আইনের মালিকও তারা।

সংসদীয় গণতন্ত্র এমন একটি ‘মনোহরণী ডাইনী’ যা মধ্যবিত্ত, নিম্ন মধ্যবিত্ত এবং বিত্তহীনদেরকে সংসদীয় নির্বাচনের রঙিন ফানুস উড়িয়ে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা দখল এবং শেয়ার করার জন্য অব্যহত ভাবে প্রলুব্ধ করে বেড়ায়। কিন্তু বিত্তহীনরা আশায় আশায় নিরর্থক ঘুরতেই থাকে কেবল। মরুভূমির ক্লান্ত পথিকের ন্যায় বিত্তহীনরাও ‘সংসদীয় গণতন্ত্র’ নামক মরীচিকাটির পেছনে ছুটতেই থাকে। গণতন্ত্র বিত্তহীনদের কাছে ধরা দেয় না।

কোটি কোটি মানুষকে ভুখ-নাঙ্গা এবং অবহেলিত রেখে পুঁজিবাদ সংসদীয় গণতন্ত্রে মাধ্যমে সমাজের মুষ্টিমেয় বিত্তবানের হাতে যাবতীয় সম্পদ এবং উৎপাদনযন্ত্রের মালিকানা কেন্দ্রীভূত করে- এটাই পুঁজিবাদের চূড়ান্ত লক্ষ্য, চরিত্রগত বৈশিষ্ট্য। এমন বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন একটি রাজনৈতিক দর্শনকে সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় মূলনীতির প্রথম স্তম্ভ করার মধ্য দিয়ে জনদরদী, দেশদরদী নামে পরিচিত শেখ মুজিব এবং তাঁর আওয়ামী লীগ কি ভাবে বাংলার কোটি কোটি দূঃস্থ, শোষিত মানুষের মুখে হাসি ফোটানোর স্বপ্ন দেখেছিলেন? পুঁজিবাদী সমাজ কাঠামো বহাল রেখে যারা সমাজের সংখ্যাগরিষ্ঠ শোষিত নির্যাতিত মানুষের মুখে হাসি ফোটানোর স্বপ্ন দেখেন, কিংবা ওয়াদা করেন, তারা হয় অজ্ঞ না হয় তাঁর চরম প্রতারক। ...”

আজ আমাদের দেশের দুই প্রধান রাজনৈতিক দল এই সংসদীয় গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার জন্য আন্দোলনের নামে মুখে ফেনা তুলে ফেলছে! এর পিছনে তাদের কায়েমী স্বার্থবাদী সামন্ততান্ত্রিক মনোভাব আমাদের কাছে স্পষ্ট হয়েছে। আজ আওয়ামী লীগ এবং বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের এমপিদের ভিতর খুঁজে দেখলে ব্যবসায়িই (এদের ভিতরে গার্মেন্ট মালিকও রয়েছেন। দিনে দিনে তাদের সংখ্যা আশঙ্কাজনক হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে) অধিক, রাজনীতিবিদ নেতা কম পাওয়া যাবে। আর এই পুঁজিবাদী মহলের স্বার্থকে রক্ষা করতে গিয়ে সরকার কখনো তাদেরকে পাশ কাটিয়ে শ্রমিকদের পক্ষ নিতে পারেনা। এজন্যই শ্রমিকদের ন্যুনতম অধিকারের জন্য বারবার দাবী-দাওয়া নিয়ে রাজপথে নামতে হয়। তোবা গ্রুপের ঐ গার্মেন্টটির শ্রমিকদের সামান্য ন্যায্য দাবী মেনে নেওয়াটা মালিকের কিংবা সরকারের পক্ষ থেকে মেনে নিতে বাধ্য করানোটা কোনো ব্যাপারই ছিল না। কিন্তু দু’পক্ষের মধ্যকার সৃষ্টিলগ্ন থেকে চলে আসা শ্রেনী-সংঘাতের কারণেই তাঁর নিরসন হচ্ছে না। Good Luck

বিষয়: রাজনীতি

১০৫৯ বার পঠিত, ১৪ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

263893
১১ সেপ্টেম্বর ২০১৪ সকাল ১০:৫৫
আমজনতার কথা লিখেছেন :
১১ সেপ্টেম্বর ২০১৪ সকাল ১১:০৫
207444
মামুন লিখেছেন : চাবিটা কি আপনার কাছে??
এভাবে আর কত দিন থাকবেন??
263896
১১ সেপ্টেম্বর ২০১৪ সকাল ১১:২০
কাহাফ লিখেছেন : সময়োপযোগী কাংখিত একটা পোস্টের জন্যে আন্তরিক মোবারকবাদ জানাচ্ছি মামুন ভাই। অনেকের অন্ধবিবেক খুলে দিতে এ পোস্ট অনেক ভূমিকা রাখুক এই কাম্য। তবে....সত্যের সাথে থাকতে হলে অবশ্যই সত্যপন্থী দলের সাপোর্ট করতেই হবে তা যে কোন ভাবেই হোক।সাহিত্যের জায়গায় আপনারদের মত প্রকৃত মানবতাবাদীদের সত্যের সাপোর্ট আমাদের কে সঠিক পথের দিশা দেখাবে।আল্লাহ আপনাদের সর্বাংগীন মংগল করুন,আমিন।
১১ সেপ্টেম্বর ২০১৪ সকাল ১১:৩৬
207449
মামুন লিখেছেন : আপনাকেও আপনার নান্দনিক মন্তব্যের জন্য অনেক অনেক মোবারকবাদ!
ভালো থাকবেন।
জাজাকাল্লাহু খাইর।Happy Good Luck
263904
১১ সেপ্টেম্বর ২০১৪ সকাল ১১:৪০
নিউজ ওয়াচ লিখেছেন : ভালো লাগলো ধন্যবাদ
১১ সেপ্টেম্বর ২০১৪ সকাল ১১:৪৬
207454
মামুন লিখেছেন : আপনাকেও ধন্যবাদ।Happy Good Luck
263973
১১ সেপ্টেম্বর ২০১৪ দুপুর ০২:৫২
egypt12 লিখেছেন : চুপ Don't Tell Anyone
১১ সেপ্টেম্বর ২০১৪ দুপুর ০৩:৪৪
207516
মামুন লিখেছেন : কতদিন চুপ করে থকবেন আর?
264114
১১ সেপ্টেম্বর ২০১৪ রাত ১০:২১
রিদওয়ান কবির সবুজ লিখেছেন : ভালো লাগলো
লি কুয়ার ইউ বা মাহাথির মুহাম্মদ মানুষের বাকস্বাধিনতা কখনও এভাবে হরন করেননি। মাহাথির মুহাম্মদ কে পার্লামেন্ট এ যথষ্ট বিরোধিতার সম্মুখিন হতে হয়েছিল। এছাড়া তার সময়ও কয়েকটি প্রদেশে সবসময় বিরোধি দলের সরকার ছিল। তারা নিজেদের কাজ শক্তি প্রয়োগ করে করেছিলেন তাই বলে মানুষের বাকস্বাধিনতা কখনও হরন করেননি। আর সময় মত ক্ষমতা ছেড়ে দিয়েছিলেন।
১১ সেপ্টেম্বর ২০১৪ রাত ১০:৩৮
207634
মামুন লিখেছেন : কিন্তু মাহাবুবুল হক শাকিল এই ঘটনাগুলোকেই ফেসবুকে অন্যভাবে তুলে ধরেছেন।
ধন্যবাদ আপনাকে সঠিক তথ্যটি জানানোর জন্য।
অনেক শুভেচ্ছা।Happy Good Luck
264196
১২ সেপ্টেম্বর ২০১৪ সকাল ০৯:০৯
বুড়া মিয়া লিখেছেন : আপনার থেকে এ ধরনের লেখা মনে হয় এই প্রথম পড়লাম, নম্রভাবে খুবই ভালো লিখেছেন, যদিও আপনি আমার চাইতে বয়সে বড়, তারপরেও বলি - মনে হয় আপনি বেশ শান্ত-শিষ্ট স্বভাবের।
১২ সেপ্টেম্বর ২০১৪ সকাল ০৯:৩১
207706
মামুন লিখেছেন : ধন্যবাদ আপনার সুন্দর মন্তব্যের জন্য।
হ্যা,ব্লগে যে কেউ স্বাধীনভাবে মত প্রকাশ করতে পারে, এর জন্য সেই ব্লগের উপর বার বার খড়গ হস্ত নেমে আসাটা ঠিক মনে হল না। অনেকেই প্রতিবাদ করছেন, আমিও কিছু একটা প্রতিবাদ করতে চেয়েছিলাম।
ধন্যবাদ এবং শুভেচ্ছা আপনাকে।Happy Good Luck
268411
২৪ সেপ্টেম্বর ২০১৪ রাত ১০:৪০
আহ জীবন লিখেছেন : আপনার প্যানডোরার বাক্স গল্পের মত এই সরকার ও চায় বাক স্বাধীনতার নামে সত্য ইতিহাস কে বন্দী করে রাখতে। হয়তো আমরা থাকবনা কিন্তু ইতিহাস প্রতিশোধ নেবে ঠিকই। আজকের মন্ত্রিদের ইতিহাস এই মন্ত্রিদের ভবিষ্যৎ কোনও না কোনও প্রজন্ম ঠিকই ফাঁস করে দিবে।

কুলিক তো কম গোপনীয়তা অবলম্বন করে নাই। তবুও সত্য বের হইল।
২৫ সেপ্টেম্বর ২০১৪ সকাল ০৮:০৬
212234
মামুন লিখেছেন : ধন্যবাদ।
খুব সুন্দরভাবে আপনি আমার লিখাগুলো পড়েন বোঝাই গেলো।
আপনার সাথে ১০০ ভাগ সহমত।
শুভেচ্ছা রইলো।
জাজাকাল্লাহু খাইর।Happy Good Luck

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File